আটকানো হলো স্বাস্থ্যকর্মীদের গাড়ি, দেওয়া হলো মামলাও

Passenger Voice    |    ১২:৪৬ পিএম, ২০২১-০৪-১৫


আটকানো হলো স্বাস্থ্যকর্মীদের গাড়ি, দেওয়া হলো মামলাও

ঢাকা: রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের কোভিড-১৯ ইউনিটের চিকিৎসক ডা. নাজমুল ইসলাম। পিতার কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ায় মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকা আসা যাওয়ার মাধ্যমেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য গাড়ি ব্যবহার করলে সংক্রমণ ছড়াতে পারে আর তাই নিজেই গাড়ি চালিয়ে ঢাকা এসে ডিউটি করেন। সরকারিভাবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও বিধিনিষেধ আরোপের প্রথম দিন তার গাড়ি আটকানো হয় রাজধানীর প্রবেশমুখের দিকে। এ সময় নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে হাসপাতালের কার্ড দেখালেও তিন হাজার টাকা জরিমানা করে মামলা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে।

রাজধানীর অভ্যন্তরে কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল বলে পরিচিত কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের গাড়ি আটকে রাখা হয় দুই ঘণ্টা। কামারপাড়া এলাকায় তাদের গাড়ি আটকানো হয়। জানতে চাওয়া হয় বিধিনিষেধের মাঝে হাসপাতালে কী কোনো কাজ হয়?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) একজন কোভিড-১৯ ইউনিটের চিকিৎসক হাসপাতালে প্রবেশ করেন রাস্তায় কোনো বাধা ছাড়াই। কিন্তু গাড়ি বের হওয়ার পরে সেটি চিকিৎসক লোগো থাকার পরেও আটকানো হয় বিএসএমএমইউ'র সামনেই। বলা হয় বিধিনিষেধ আরোপের পরেও গাড়ি রাস্তায় বের হওয়াতে ৩ হাজার ৫০০ টাকার মামলা দেওয়া হবে। পরবর্তীতে মামলা না দিলেও সেখানে কথাবার্তার মাধ্যমে সমাধান করা হয়। তবে কর্তব্যরত পুলিশের বিরুদ্ধে এক হাজার টাকা নিয়ে ছাড়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

শুধুমাত্র রাজধানীতেই নয়, চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে নিজ কর্মস্থলে যাওয়ার সময় গাড়ি আটকানো হয় আরেকজন চিকিৎসকের। এ সময় তাকে বলা হয়, সিভিল সার্জনের অনুমতি ছাড়া গাড়ি নিয়ে বের হওয়া যাবে না৷ আর তাই ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামলা দিতে বলেছেন।

দেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ভাবে দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের প্রথম দিনে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে। তবে আইনশৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে যুক্ত কাউকে আটকানো হচ্ছে না।

দেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ১৪ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ভাবে দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে এই কঠোর বিধিনিষেধ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনে থাকা সব প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আইন-শৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন- কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরগুলোর (স্থল, নদী ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতা বহির্ভত থাকবে।

কিন্তু ১৪ এপ্রিল বিধিনিষেধ আরোপের প্রথম দিন কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেলো এর ব্যাত্যয়।

ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, প্রজ্ঞাপনে লেখা ছিল স্বাস্থ্যসেবা খাতের সবাই বিধিনিষেধের আওতা মুক্ত থাকবে। তাও মুভমেন্ট পাসের জন্য চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু গতকাল সেটি পাই নি। আজকে সকালে আমাকে যখন চেকপোস্টে আটকানো হয় তখন পরিচয় দেওয়ার পরেও মামলা দেওয়া হয়। আমি আমার হাসপাতালের কার্ডও দেখিয়েছি কিন্তু তাও লাভ হয়নি।

এদিন একাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেখা যায় এ বিষয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকেই।

কুর্মিটোলা হাসপাতালের একজন নার্স জানান, আমাদের সকাল ৮ টায় ডিউটি। গাড়ি আটকে দেওয়ার পরে বলি কোভিড-১৯ ইউনিটে আমরা দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু তাও আটকে রাখা হয়। আমাদেরকে উলটো বলা হয় বিধিনিষেধের মাঝে কী হাসপাতালে কোনো কাজ হয় কিনা। পরে দেখি একটা প্রেস লেখা গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হয় অথচ আমাদেরই আটকে রাখা হয়। তখন গিয়ে যখন আমরা আবার কথা বলি আমাদের ছাড়া হয়৷ আমরা হাসপাতালে পৌছায় ডিউটি শুরুর প্রায় দুই ঘণ্টা পরে।

চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিস-এফডিএসআর'র মহাসচিব ডা. শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, মহামারি কালে হাসপাতালে কর্তব্য পালনে যাওয়ার পথে চিকিৎসকদের মুভমেন্ট পাসের নামে হয়রানি এবং জরিমানা আদায়ের জন্য মামলা দেওয়ার তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে এসব হয়রানি বন্ধের এবং জড়িত অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।

চিকিৎসকদের সংগঠন প্ল্যাটফর্ম অব মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল সোসাইটির উপদেষ্টা মো. মুরাদ হোসেন মোল্লা বলেন, কোভিড সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আরোপিত লকডাউনে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মস্থলে যাতায়াত বিড়ম্বনার দৃশ্যটি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত, অগ্রহণযোগ্য। যে উদ্দেশ্যে লকডাউন, সেই চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের বাধা প্রদান, তা যে কারণেই হোক, অত্যন্ত গর্হিত। দ্রুত এই পরিস্থিতির উন্নতি হোক এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। এমনকি পারিবারিক জরুরি কাজে বের হলেও তাদের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ঘরের কাজটি সেরেই তাকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে।’

 এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, ‘এভাবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের যদি বাধা দেওয়া হয় তবে সেবা দেবে কারা? সরকারের যে নির্দেশনা তাতে তো চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের বাধা দেওয়া কথা না। সেখানে বলাই হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা খাত এই বিধিনিষেধের আওতামুক্ত থাকবে। তারপরেও কেনো এমন অবিচার? এতে করে আমি মনে করি মহামারিকালে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হবে আর মানুষের চিকিৎসাসেবা পেতে ভোগান্তি বাড়বে।’

জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্তরা নির্দেশনা অনুযায়ীই কিন্তু বিধিনিষেধের আওতামুক্ত। যদি তারপরেও মামলা দেওয়ার বিষয় ঘটে থাকে তবে যদি সেই এলাকার ট্রাফিক বিভাগের ডিসি বরাবর অভিযোগ জানানো হয় অবশ্যই সেটির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।